ট্যাংরায় জোড়া খুনের কিনারা, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের জেরেই খুন, গ্রেপ্তার মৃতার স্বামী
নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা : ট্যাংরা থানা এলাকার নিউ ট্যাংরা রোডের বাড়িতে বাবা ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন নেপালি যুবক লি আন থো। শুক্রবার রাত আটটা কুড়ি নাগাদ বাড়ি ফিরে তিনি দেখতে পান, ভেতর থেকে বাড়ির সদর দরজাটি বন্ধ। হাজার ডাকাডাকি করেও দরজা না খোলায় সন্দেহ জাগে তাঁর। আতঙ্কিত হয়ে তিনি ছুটে যান পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে চোখে মুখে উদ্বেগ এবং আতঙ্কের ছাপ দেখে তাঁর ডাকে ছুটে আসেন প্রতিবেশী ও স্থানীয় ক্লাবের ছেলেরা। তাঁরা এসে দেখেন বাড়ির সদর দরজা ভেতর থেকে লক করা, ধাক্কাধাক্কি করেও ভেতর থেকে কারো সাড়া পাওয়া যায়নি বলে দাবি। এরপর দরজার এক ফাঁক দিয়ে দেখা যায়, ভেতর রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন ওই যুবকের স্ত্রী। সঙ্গে সঙ্গেই খবর দেওয়া হয় ট্যাংরা থানায়। খবর পেয়ে বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছন ট্যাংরা থানার ওসি। দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখা যায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে ওই যুবকের স্ত্রী এবং তাঁর বৃদ্ধ বাবাও। রক্তাক্ত অবস্থায় দুজনকে উদ্ধার করে নীলরতন সরকার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাদেরকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিত্সকরা। এরপরেই কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বামী লি। ভরসন্ধেয় জোড়া খুনে ব্যপক চাঞ্চল্য ছড়ায় এলাকায়। ঘটনার তদন্ত শুরু করে ট্যাংরা থানার পুলিশ।
পুলিশ সূত্রে খবর, তদন্তে নেমে দেখা যায় দুটি মৃতদেহের মুখেই ভারী কিছু বস্তু দিয়ে আঘাত করার চিহ্ন রয়েছে। তখনই তদন্তকারি আধিকারিকেরা এক প্রকার প্রায় নিশ্চিত হন, তাঁদের দুজনকেই ভারী কোনও বস্তু দিয়ে আঘাত করেই খুন করা হয়েছে। কিন্তু কি সেই ভারী বস্তু? জানতে ফের ঘটনাস্থলে পৌঁছয় ট্যাংরা থানার পুলিশ বাহিনী। মৃতের বাড়ির ভেতরের আশপাশ পরীক্ষা করে দেখা যায়, বাড়ির কোনও জিনিসপত্র লুট করা হয়নি, সবকিছুই স্বাভাবিক ভাবে সাজিয়ে রাখা ছিল এরপরেই বাড়িতে থাকা একটি ভারী বালতি দেখে সন্দেহ হয় তদন্তকারীদের। সূত্রের খবর ওই বালতির মধ্যে রক্তের দাগ দেখতে পান তদন্তকারীরা। এই বালতি দিয়ে যে তাঁদের দুজনকে মুখে আঘাত করে খুন করা হয়েছে তা নিশ্চিত হয়ে যায় পুলিশ। এরপর প্রাথমিক জেরা করা হয় মৃতের স্বামী লিগ আন থোকে। পুলিশি জেরার মুখে তিনি জানান, ঘটনার সময় তিনি বাড়িতেই ছিলেন না। সন্ধে সাতটা এগারো তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন এবং রাত আটটা কুড়ি নাগাদ ফের বাড়ি ফিরে এই ঘটনা দেখতে পান তিনি। বাড়ির দরজা না খোলায় প্রতিবেশীদের ডেকে আনেন। তাঁর বয়ানে কিছুটা সন্দেহ জাগে তদন্তকারী আধিকারিকদের। শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে তাঁর মোবাইল টাওয়ার লোকেশন ট্রেস করে দেখা যায়, ঘটনার সময় বাড়ির বাইরে মোটেই নয়, নিজের বাড়ির ভেতরেই ছিল তাঁর গতিবিধি। এরপরেই তাকে গ্রেফতার করে ট্যাংরা থানার পুলিশ। চলে রাতভর জেরা।
পুলিশ সূত্রে খবর, লাগাতার জেরার মুখে ভেঙে পড়ে ধৃত লি। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে রীতিমতো কান্নায় ভেঙে পড়ে সে জানিয়েছে, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কারণে অশান্তির জেরেই এই খুন করেছে সে। স্থানীয় সূত্রে খবর, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ওই বাড়িতে প্রায় রোজই অশান্তি লেগে থাকত বিভিন্ন কারণে প্রতিবেশীদের সেই দাবিকে মান্যতা দিয়েই পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে ধৃত জানায়, তাঁর সঙ্গে অন্য এক মহিলার বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল। সেই বিষয়টি কিছুদিন আগে জেনে যান তার স্ত্রী লী হৌ মেহা। শুক্রবার রাতে ফের দুজনের মধ্যে অশান্তি চরমে উঠলে, ভারী বালতি দিয়ে স্ত্রীর মুখে আঘাত করে সে। এরপরেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন স্ত্রী। পুত্রবধূকে মারতে দেখে তাঁকে বাঁচাতে ছুটে আসেন ওই যুবকের বাবা। রাগের মাথায় বৃদ্ধ বাবার মুখেও একই কায়দায় আঘাত করে বসে ওই যুবক। এরপর স্ত্রীর পাশে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তাঁর বাবা লি কা সং। তারই আঘাতে স্ত্রী ও বাবার মৃত্যু হয়েছে জানতে পেরে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সে নিজেও। এর পরই নিজের গা বাঁচাতে এবং পুলিশকে বিভ্রান্ত করতেই দরজাটি ভেতর থেকে লক করে কোনও কায়দায় বাইরে বেরিয়ে এসে প্রতিবেশীদের কাছে ছুটে যায় ওই যুবক। যদিও এই নাটকের টানটান চিত্রনাট্য শেষ পর্যন্ত কাজে এল না। নিজের বাবা এবং স্ত্রীকে খুনের দায়ে পুলিশের জালে ধরা পড়ল ওই যুবক। আজ তাকে শিয়ালদহ আদালতে পেশ করে নিজেদেরকে বাঁচাতে চাইবে ট্যাংরা থানার পুলিশ।