বৌঠানের প্রিয় রবি
নিউজ ডেস্ক: বাড়ির ছোট্ট ছেলেটির হঠাৎ মনে হল, এতদিন যে রাজার বাড়ি খুঁজে খুঁজে সে হয়রাণ হয়েছে, খুঁজে পায়নি, সেই বাড়িটিরই সব থেকে কাছের মানুষ হয়ে উঠল রাজকন্যে কাদম্বরী দেবী। মাত্র আট বছর বয়সে সে পেল তাঁর নতুন বৌঠান। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী। কিশোর রবীন্দ্রনাথের মনোগঠনে কাদম্বরী দেবীর ভূমিকা অসামান্য। তাঁর অকালমৃত্যু কবির জীবনে এক বিশাল ক্ষত রেখে যায়। কবি তার অসংখ্য কবিতা ও গানের মধ্যে দিয়ে ব্যক্ত করেছেন তার প্রিয় বউঠানকে।
কাদম্বরী দেবী কলকাতার মেয়ে। তাঁর বাবা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির যোগাযোগ ছিল অনেকদিন থেকেই। ধীরে ধীরে ছোট্ট কাদম্বরীই হয়ে উঠলেন ঠাকুরবাড়ির যোগ্যতমা বৌমা। তিন তলার ছাদের ওপর গড়ে তুলেছিলেন তার নন্দন কানন। পিল্পের ওপর সারি দিয়ে বসানো হল লম্বা পামগাছ, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, করবী, দোলনচাঁপা। সেখানে যেন প্রতিদিনই আনাগোনা হল নানা পাখির। তিনি বদলে দিলেন গোটা বাড়ির চেহাড়া।
কাদম্বরী দেবী অসাধারণ সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন। তিনি শুধু সময় কাটানোর জন্যই বই পড়তেন না, উপভোগও করতেন সমস্তটাকে। দুপুরবেলা রবি ঠাকুর তাঁকে নিজের লেখা পড়ে শোনাতেন। হাতপাখা নিয়ে হাওয়া করতেন বৌঠান। ‘ভারতী’ পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে তাঁর নাম ছিল না ঠিকই, কিন্তু তিনিই ছিলেন এই কবিতার প্রাণ! সেটা প্রকোট হয় কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পর।
‘নন্দন কানন’-এ সন্ধেবেলায় বসত গান ও সাহিত্যপাঠের পরিপাটি আসর। মাদুরের ওপর তাকিয়া, রূপোর রেকাবে ভিজে রুমালের ওপর বেলফুলের গোড়ের মালা, এক গ্লাস বরফজল, বাটা ভর্তি ছাঁচি পান সাজানো থাকত। কাদম্বরী গা ধুয়ে, চুল বেঁধে তৈরি হয়ে বসতেন সেখানে। জ্যোতিরিন্দ্র বাজাতেন বেহালা, রবীন্দ্র ধরতেন চড়া সুরের গান। বাড়ির অনেকে আসতেন সেখানে। বাইরে থেকে আসতেন অক্ষয় চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী শরৎকুমারী, কবি বিহারীলাল সহ অনেকেই।
পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর নতুন বৌঠানকে নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। অনুচিত সন্দেহ দানা বেঁধেছে। বিশেষ করে কবির বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই কাদম্বরীর মৃত্যু নানা সংশয় তৈরি করেছিল। কিন্তু একটা কথা স্বীকার করতেই হয়, রবীন্দ্রমানস গঠনে এই নারীর ভূমিকা ছিল সবথেকে বেশি।
বৌদিদির চোখে নিজেকে যত দামী করে তোলার চেষ্টা করতেন সব সময়। রবি দিনরাত চেষ্টা করত যাতে বৌঠানের চোখে তার আর কোনও দোষ ধরা না পড়ে। বাচ্চা রবি বুঝতেন না, রবিকে একেবারে নিখুঁত করে তোলার সাধনাই করছেন বৌঠান। যখন রবি একথাটা বোঝার মতো বয়স হল তখন তাঁর বৌঠান হারিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু কবির কথায় বারবার ফিরে এসেছেন তিনি, বড় ভালবাসতুম তাঁকে। তিনিও আমায় খুব ভালবাসতেন।