আজাদ হিন্দ বাহিনির প্রথম মহিলা ক্যাবিনেট সদস্যা লক্ষ্মী সেহগলকে চেনেন?

0 0
Read Time:9 Minute, 22 Second

নিউজ ডেস্ক::আমরা স্বাধীনতার কয়েক দশক পেরিয়ে এসেছি। তবে, বর্তমানে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ওঠে কতখানি স্বাধীন আমরা। আমরা কি আদৌ স্বাধীন? দেশের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, দারিদ্র্যের ভয়ংকর থাবা, শিক্ষার ডামাডোল অবস্থা, নারী সমাজের নিরাপত্তাহীনতা, বঞ্চনা-লাঞ্ছনা, যুব সমাজের নৈতিক অবক্ষয়, সব মিলিয়ে মাঝে মধ্যেই মনে হয় একেই বলে স্বাধীনতা। আর তখনই লক্ষ্মী সেহগলের ওপরের কথাগুলো বড়ো বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ সেনানী হলেন ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগল স্বামীনাথন যিনি ছিলেন আজাদ হিন্দ সরকারের প্রথম মহিলা ক্যাবিনেট সদস্যা। পাশাপাশি তিনি হলেন প্রথম মহিলা যিনি দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।

১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে অক্টোবর মাদ্রাজের মালাবারে লক্ষ্মী স্বামীনাথনের জন্ম। তাঁর বাবা সুব্বারাম স্বামীনাথন ছিলেন একজন উকিল। তিনি মাদ্রাজ হাইকোর্টের উকিল। তাঁর মা এভি অম্মুকাট্টি, যিনি পরিচিত ছিলেন অম্মু স্বামীনাথন হিসেবে। তিনি ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সমাজসেবী। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি গণপরিষদের সদস্য হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি মহারাষ্ট্র থেকে রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে লক্ষ্মী ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর বাবা ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তাধারার মানুষ। জাত কিংবা ধর্মীয় ভেদাভেদকে যেমন তিনি প্রশ্রয় দেননি তেমনি সংসার জীবনে ছেলেমেয়েদের মধ্যে তিনি কোনো ফারাক রাখেননি। তাঁদের দুই পুত্র গোবিন্দ ও সুব্বারাম এবং কন্যা লক্ষ্মী ও মৃণালিনী, সকলকেই তিনি সমানভাবে মানুষ করেছিলেন। অম্মুকুট্টি কংগ্রেসের সদস্য হওয়ায় বাড়িতে অনেক বড়ো বড়ো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের আনাগোনা ছিল। ছোটোবেলা থেকেই লক্ষ্মী তাঁদের সংস্পর্শে এসেছিলেন। বাবা-মায়ের গুণের সংমিশ্রন দেখা যায় লক্ষ্মীর চরিত্রের মধ্যে। একদিকে তিনি যেমন ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, অন্যদিকে ছিলেন একজন সক্রিয় সমাজসেবী ও একজন রাজনীতিবিদ।

ছোটোবেলা থেকেই লক্ষ্মী ছিলেন অন্যদের থেকে একটু আলাদা। তাঁর মধ্যে ছিল প্রতিবাদের গুণ শৈশব থেকেই। শৈশবেই তিনি প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন জাতপাতের বিরুদ্ধে। তাঁর দিদিমার বাড়ি থেকে প্রায়শই তিনি শুনতে পেতেন আশপাশের জঙ্গল ও পাহাড় থেকে তীব্র চিৎকার ও চেঁচামেচি। তাঁর দিদিমার কথায় এরা হল সেই মানুষ যাদের ছায়াও দূষিত। ছোট্ট লক্ষ্মী দিদিমার এমন কথা মানতে পারে না। একদিন তিনি একটি উপজাতি মেয়ের কাছে যান এবং তার হাত ধরে খেলা করেন। দিদিমা খুব রেগে যান কিন্তু লক্ষ্মী হার মানেননি।

শৈশবেই যিনি এমন তিনি যে ভবিষ্যতে বড়ো কিছু করার জন্য এসেছেন তা সহজেই অনুমেয়। আসলে তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে অনেকটাই অগ্রবর্তী। সেই সময় যখন অধিকাংশ মেয়ে নিজেদের আবদ্ধ রাখত রান্নাঘরে, সেখানে লক্ষ্মী স্বপ্ন দেখতেন দেশের কাজ করার, দুঃস্থ অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াবার। চিকিৎসা শাস্ত্রে ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। তাই স্কুলের পড়া শেষ করার পর তিনি মাদ্রাজে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। ডাক্তারি পড়ার সময়ই তাঁর বিয়ে হয় টাটা এয়ারলাইনসের পাইলট পিকেএন রাও-এর সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের তিন মাসের মধ্যে তিনি বুঝতে পারেন সিদ্ধান্তটি ঠিক হয়নি। তিনি বোম্বে থেকে মাদ্রাজ চলে আসেন ডাক্তারি ডিগ্রি পূরণ করার জন্য। ক্ষুব্ধ স্বামী তাঁকে ডিভোর্স দেন না। যে কারণে তাঁকে বেশ কিছু সমস্যায়ও পড়তে হয়। যাই হোক, ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি এমবিবিএস পাশ করেন। এর এক বছর পর গাইনোকোলজি ও অবস্টেট্রিক্স বিষয়ে ডিপ্লোমা অর্জন করেন। ডাক্তার পাশ করার পর তিনি চেন্নাইয়ের ত্রিপলিক্যান এলাকার সরকারি কস্তুর্বা গান্ধি হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে পেশাদারী জীবন শুরু করেন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে পিকেএন রাএ-এর সঙ্গে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। পরবর্তীকালে প্রেমকুমার সেহগলকে তিনি বিয়ে করেন।

ছোটোবেলা থেকে তাঁর মধ্যে ছিল দেশপ্রেমবোধ। বিদেশী দ্রব্য বর্জনের ডাকে তিনি তাঁর বিদেশী পোশাক, খেলনা পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। কলেজে পড়ার সময় তিনি ছিলেন কংগ্রেসের যুব শাখার সদস্য। তাঁর ইচ্ছে ছিল দেশের মানুষের জন্য কাজ করা। তার জন্য তিনি চেয়েছিলেন আগে নিজেকে গড়ে তুলতে। গান্ধিজির কিছু কিছু সিদ্ধান্ত তিনি মানতে পারেননি। যেমন স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহনের জন্য ছাত্রসমাজের স্কুল কলেজ ত্যাগ করার যে আহ্বান গান্ধিজি দিয়েছিলেন তা তিনি সমর্থন করেননি।

১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিঙ্গাপুর যান এবং সেখানে গরিব মানুষদের চিকিৎসার জন্য একটি ক্লিনিক খোলেন। তখন থেকেই তিনি একটু একটু করে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলেন যুক্ত হতে থাকেন। রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লিগে তিনি যোগদান করেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই সিঙ্গাপুরে আসেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। লক্ষ্মী প্রথম নেতাজীকে দেখেছিলেন ১৯২৮-এর ডিসেম্বর মাসে, কলকাতায়। তখন থেকে তাঁর নেতাজীর প্রতি ছিল গভীর শ্রদ্ধা। ৫ই জুলাই তিনি কেপি কেসভা মেননের কাছে জানতে চান সিঙ্গাপুরে এমন কোনো মহিলা আছেন কিনা যিনি তাঁর প্রস্তাবিত নারী বাহিনি ঝাঁসির রাণি বাহিনি-র উপযুক্ত হবেন। শ্রী মেনন তাঁকে লক্ষ্মী স্বামীনাথনের কথা বলেন। সেদিনই নেতাজীর সঙ্গে লক্ষ্মীর সাক্ষাৎ হয় এবং প্রায় ছয় ঘন্টা সেদিন তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা হয়। এরপর নেতাজীর আহ্বানে লোভনীয় কর্মজীবন ত্যাগ করে তিনি নারী বাহিনিতে যোগ দেন এবং এর গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন। সমগ্র এশিয়ায় এই ধরনের নারি বাহিনি ছিল এই প্রথম। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২১ অক্টোবর যখন আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তিনি ছিলেন এই সরকারের প্রথম এবহং একমাত্র ক্যাবিনেট সদস্যা। শীঘ্রই তিনি আজাদ হিন্দ বাহিনির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠেন এবং এর নারী সংগঠন বিভাগের মন্ত্রী হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!