দুর্গাপূজা — পৌরাণিক উপাখ্যান

নিউজ ডেস্ক ::দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব (সংস্কৃত: दुर्गा पूजा) হল দেবী দুর্গার পূজাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত একটি হিন্দু উৎসব। এটি সারা বিশ্বে হিন্দু সম্প্রদায়ের দ্বারা পালিত হয়, তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ওড়িশা, বিহার, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড, উত্তর প্রদেশ (পূর্বাঞ্চল) এবং বাংলাদেশে ঐতিহ্যগত বিশেষভাবে উদযাপিত হয়। এটি বাংলা বর্ষপঞ্জির আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। দুর্গাপূজা মূলত দশ দিনের উৎসব, যার মধ্যে শেষ পাঁচটি সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। আশ্বিনের নবরাত্রির পূজা শারদীয় পূজা এবং বসন্তের নবরাত্রির পূজা বাসন্তিক বা বসন্তকালীন দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কলকাতার দুর্গাপূজা ইউনেস্কোর অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত করা হয়।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এ কৃষ্ণকে দুর্গাপূজার প্রবর্তক বলা হয়েছে। বিভিন্ন দেবদেবীরা কীভাবে দুর্গাপূজা করেছিলেন, তার একটি তালিকা এই পুরাণে পাওয়া যায়। তবে এই প্রসঙ্গে কোনো পৌরাণিক গল্পের বিস্তারিত বর্ণনা এই পুরাণে দেওয়া হয়নি।

অর্থাৎ, সৃষ্টির প্রথম যুগে পরমাত্মা কৃষ্ণ বৈকুণ্ঠের আদি-বৃন্দাবনের মহারাসমণ্ডলে প্রথম দুর্গাপূজা করেন। এরপর মধু ও কৈটভ নামে দুই অসুরের ভয়ে ব্রহ্মা দ্বিতীয় দুর্গাপূজা করেছিলেন। ত্রিপুর নামে এক অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে শিব বিপদে পড়ে তৃতীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। দুর্বাসা মুনির অভিশাপে লক্ষ্মীকে হারিয়ে ইন্দ্র যে পূজার আয়োজন করেছিলেন, সেটি ছিল চতুর্থ দুর্গাপূজা। এরপর থেকেই পৃথিবীতে মুনিঋষি, সিদ্ধপুরুষ, দেবতা ও মানুষেরা নানা দেশে নানা সময়ে দুর্গাপূজা করে আসছে।

দেবীভাগবত পুরাণ

শাক্তধর্মের অন্যতম প্রধান ধর্মগ্রন্থ দেবীভাগবত পুরাণ অনুসারে, ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু পৃথিবীর শাসক হয়ে ক্ষীরোদসাগরের তীরে দুর্গার মাটির মূর্তি তৈরি করে পূজা করেন। এই সময় তিনি “বাগ্‌ভব” বীজ জপ করতেন এবং আহার ও শ্বাস গ্রহণ ত্যাগ করে এক পায়ে দাঁড়িয়ে একশো বছর ধরে ঘোর তপস্যা করেন। এর ফলে তিনি শীর্ণ হয়ে পড়লেও, কাম ও ক্রোধ জয় করতে সক্ষম হন এবং দুর্গানাম চিন্তা করতে করতে সমাধির প্রভাবে স্থাবরে পরিণত হন। তখন দুর্গা প্রীত হয়ে তাকে বর দিতে আসেন। মনু তখন দেবতাদেরও দুর্লভ একটি বর চাইলেন। দুর্গা সেই প্রার্থনা রক্ষা করেন। সেই সঙ্গে দুর্গা তার রাজ্যশাসনের পথ নিষ্কণ্টক করেন এবং মনুকে পুত্রলাভের বরও দেন।

দেবীমাহাত্ম্যম্‌

দুর্গা ও দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যতগুলি পৌরাণিক গল্প প্রচলিত আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পটি পাওয়া যায় শ্রীশ্রীচণ্ডী বা দেবীমাহাত্ম্যম্-এ। এই গল্পটি হিন্দুরা এতটাই মান্য করে যে শ্রীশ্রীচণ্ডীর পাঠ দুর্গাপূজার একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। দেবীমাহাত্ম্যম্ আসলে মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এর একটি নির্বাচিত অংশ। এতে তেরোটি অধ্যায়ে মোট সাতশোটি শ্লোক আছে। এই বইতে দুর্গাকে নিয়ে প্রচলিত তিনটি গল্প ও
দুর্গাপূজা প্রচলনের একটি গল্প রয়েছে। প্রতিটি গল্পে দুর্গাই কেন্দ্রীয় চরিত্র।

কালিকা পুরাণ

যদিও কালিকা পুরাণের মূল উপজীব্য বিষয় কামাখ্যা মন্দির ও নরকাসুর বৃত্তান্ত – তবুও এর ৫৭,৫৮,৫৯, ৬০, ৬১তম অধ্যায়ে দুর্গাপূজার রীতিনীতির বিস্তারিত বিবরণ বিধৃত আছে, পূজায় ব্যবহার্য্য “জটাজুটসমাযুক্তাং ….” ধ্যানমন্ত্রটির উল্লেখ আছে আর তাই এই পুরাণের আলোচনা এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। বিশেষতঃ ৬০ তম অধ্যায়ে মহিষাসুর বধের কাহিনী আছে যা দেবীভাগবত,মার্কণ্ডেয় বা বামন পুরাণের কাহিনী থেকে স্বতন্ত্র।

উপাখ্যানটির বিন্যাস মহাদেব আর বেতাল-ভৈরবের কথোপকথনের মাধ্যমে। কাহিনীর সূচনায় মহিষাসুরের বিনাশ কামনায় দেবতাদের সম্মিলিত স্তুতিতে প্রসন্নচিত্ত মহামায়া ষোড়শভুজা ভদ্রকালী রূপে আবির্ভূতা হয়ে দেবতাদের কাত্যায়নের আশ্রমে যেতে আদেশ করেন। সেখানে দেবতারা আদ্যাদেবীর দর্শনলাভের আশায় যান ও ত্রিমূর্তির ( ব্রহ্মা, বিষ্ণু , মহেশ্বর) সাক্ষাৎ লাভ করেন, ক্রমে তাঁরা মহিষাসুরের অত্যাচার-উৎপীড়নের কথা তুলে ধরলে ত্রিমূর্তি কোপাবিষ্ট হন। তাঁদের ও অন্যান্য দেবতাদের ক্রোধরশ্মি সুবৃহৎ এক তেজচক্র সৃষ্টি করে, যা ক্রমে দশভুজা তপ্তকাঞ্চনবর্ণা দেবী দুর্গার রূপ নেয়।

এদিকে মহিষাসুর নিশীথ দুঃস্বপ্নে দেবী ভদ্রকালীকে খড়্গাঘাতে তাঁর শিরশ্ছেদ করে রক্তপান করতে দেখেন। সন্ত্রস্ত অসুররাজ সপার্ষদে পরদিন সকালে দেবীর আরাধনা করলে দেবী মহামায়া তাঁকে ষোড়শভুজা অতসীপুষ্পবর্ণা ভদ্রকালী রূপে দর্শন দেন। মহিষ শিবাংশী – শিবের বরে রম্ভাসুরের ঔরসে তাঁর জন্ম, শিবের প্রসাদেই তাঁর ত্রিলোকবিজয়ের বৈভব-প্রতিপত্তি, আবার নিয়তির নির্দেশে তিনি নারীরই বধ্য, তাই জাগতিক অন্যান্য কামনার পরিবর্তে তাঁর মনে জাগে ভিন্ন এক “অমরত্ব” লাভের আকাঙ্ক্ষা। মহামায়ার হাতে মৃত্যু নিশ্চিত জেনে তাঁর কাছেই মহিষাসুর আসুরিক মনোবৃত্তির স্খালন আর যজ্ঞভাগ লাভের বর প্রার্থনা করেন। দেবী অসুরত্ব মোচনের বর দিলেও যজ্ঞভাগের মনোবাঞ্ছাটি অপূর্ণ রাখেন, বিকল্পে দেন ত্রিলোকপূজ্য হওয়ার বর। তিনি জানান যে তাঁর মহিষাসুর বধ এক সন্ততঃ ঘটনা – যুগ-যুগান্তরে, কল্পে কল্পান্তরে যা ঘটে চলেছে। ইতোপূর্বে অঞ্জননিভা অষ্টাদশভুজা উগ্রচণ্ডা ও অতসীপুষ্পবর্ণা ষোড়শভুজা ভদ্রকালী রূপে মহিষাসুরকে তিনি বধ করেছেন আর পরবর্তীতে দশভুজা তপ্তকাঞ্চনাভা কাত্যায়নী দুর্গা রূপে তাঁকে আবারো বধ করবেন। আর এই তিনরূপে দেবীর পদলগ্ন হয়ে মহিষাসুর দেব-দানব-মানব সবার পূজা পাবেন।

কৃত্তিবাসী রামায়ণ

বাল্মীকির রামায়ণে রামের দুর্গাপূজার কোনো বিবরণ নেই। কিন্তু রামায়ণের পদ্যানুবাদ করার সময় কৃত্তিবাস ওঝা কালিকাপুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ-এর কাহিনি কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে সংযোজিত করেছেন। কৃত্তিবাসি রামায়ণ অনুসারে, রাবণ ছিলেন শিবভক্ত। মা পার্বতী তাকে রক্ষা করতেন। তাই ব্রহ্মা রামকে পরামর্শ দেন, শিবের স্ত্রী পার্বতী কে পূজা করে তাকে তুষ্ট করতে। তাতে রাবণ বধ রামের পক্ষে সহজসাধ্য হবে। ব্রহ্মার পরামর্শে রাম শরৎকালে পার্বতীর দুর্গতিনাশিনী রূপের বোধন, চণ্ডীপাঠ ও মহাপূজার আয়োজন করেন। আশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিন রাম কল্পারম্ভ করেন। তারপর সন্ধ্যায় বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস করেন। মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী ও সন্ধিপূজার পরেও দুর্গার আবির্ভাব না ঘটায়, রাম ১০৮টি নীল পদ্ম দিয়ে মহানবমী পূজার পরিকল্পনা করেন। হনুমান তাকে ১০৮টি পদ্ম জোগাড় করে দেন। মহামায়া রামকে পরীক্ষা করার জন্য একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখেন। একটি পদ্ম না পেয়ে রাম পদ্মের বদলে নিজের একটি চোখ উপড়ে দুর্গাকে নিবেদন করতে গেলে, দেবী পার্বতী আবির্ভূত হয়ে রামকে কাঙ্ক্ষিত বর দেন।তবে সম্প্রতি একটি জরিপে দেখা গেছে কৃত্তিবাস ওঝা যে কাহিনী সংকলন করেছেন, তা রামচন্দ্রের প্রকৃত জীবনী বাল্মিকী রামায়ণে বা রামায়ণের অন্যান্য অনুবাদসমূহ যেমন, তুলসীদাস রচিত হিন্দি রামচরিতমানস, তামিলভাষায় কাম্ব রামায়ণ, কন্নড় ভাষায় কুমুদেন্দু রামায়ণ, অসমীয়া ভাষায় কথা রামায়ণ, ওড়িয়া ভাষায় জগমোহন রামায়ণ, মারাঠি ভাষায় ভাবার্থ রামায়ণ, উর্দু ভাষায় পুথি রামায়ণ প্রভৃতিতে উল্লেখিত হয় নি। এছাড়াও যোগবাশিষ্ট রামায়ণে উক্ত হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *