দেড়শো বছরে পা হাওড়ার এই বনেদি বাড়ির পুজো

0 0
Read Time:6 Minute, 27 Second

নিউজ ডেস্ক::দূর্গাপূজো মানেই বনেদি বাড়ির পুজোর ঝাঁকজমকে ভরপুর হয়ে ওঠা ঠাকুর দালান। আর সেই ঠাকুর দালানেই পারিবারিক মিলনতার সাথে হইহুল্লোড় করে কাটানো পাঁচটি দিন। উত্তর হাওড়ার সালকিয়ার ঢ্যাং বাড়ির পূজা এই বছর ১৪৯ তম বর্ষে পদার্পণ করল। এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক ইতিহাস আর অনেক অজানা কাহিনী সঙ্গে পুজোর বিশেষত্ব ।

হাওড়া স্টেশন থেকে সালকিয়া পেরিয়ে বাবুডাঙ্গা মোড় ডানদিকে পড়বে শ্রীরাম ঢ্যাং রোড। যাদের পূর্বপুরুষের নামে একদা উত্তর হাওড়ার এই গুরুত্বপূর্ণ রোডের নামকরণ হয়েছিল। ঢ্যাং বংশের আদিপুরুষ গুরুদাস ঢ্যাং হুগলী জেলার খানাকুলের কাছে ঝিংড়া গ্রামে বসবাস করতেন। বংশের মূল পদবী ‘দে’। ঢ্যাং উপাধি কি কারণে তারা পেয়েছিলেন সেই ইতিহাস আজও সবার কাছেই অজানা। গুরুদাস পুত্র লক্ষণ শাঁখার ব্যবসা করতেন। লক্ষণ এবং তাঁর পুত্র শ্রীরাম ঢ্যাং ঝিংড়া থেকে প্রথম সালকিয়া অঞ্চলে আসেন। শ্রীরাম ঢ্যাং প্রথম পিতলের ঢালাই কারখানা স্থাপন করে ওজন করার বাটখারা তৈরি করেন। নতুন ব্যবসায়ে শ্রীরাম ঢ্যাং উন্নতির পথ পান।

শ্রীরাম ঢ্যাং এর পাঁচ পুত্র দেবেন্দ্রনাথ, মহাদেব, শিবচন্দ্র, রাখালচন্দ্র এবং তারকনাথ। পাঁচ ভাই যৌথভাবে ঢালাই কারখানা, তেলের ব্যবসা, তুলোর ব্যবসা এবং সুদূর সুইডেনে প্রস্তুত টেক্কামার্কা দেশলাই এর এজেন্সি নেন । পাঁচ ভাইয়ের কর্মযজ্ঞে শ্রী শ্রী লক্ষীদেবীর কৃপায় সালকিয়ার অন্যতম ধনী পরিবার হয়ে ওঠে এই ঢ্যাং পরিবার।

শ্রীরাম ঢ্যাং ১৮৭৩ সালে দূর্গা পূজোর সূচনা করেছিলেন এই ঢ্যাং পরিবারে। সেই ঢ্যাং বাড়ির পূজা এখনও তার আপন বনেদিয়ানায় সবার থেকেই আলাদা। ১৪ নং ব্যানার্জী বাগান লেনের ঢ্যাং বাড়ির পূজা এবার ১৪৯ তম বর্ষে পদার্পণ করল। খিলান দেওয়া সাবেকি আদলের ঠাকুর দালানেই পূজা হয়। প্রতিষ্ঠাতা শ্রীরাম ঢ্যাং মহাশয়ের করে দেওয়া শ্রী শ্রী দূর্গামাতা ও লক্ষীমাতা সহায় নামক এস্টেট দ্বারাই পুজোর যাবতীয় খরচাপাতি পরিচালিত হয়। অন্যান্য বনেদি বাড়ির মতোই এই বাড়িরও নিজস্ব কিছু রীতি আছে। যেমন,জন্মাষ্টমীর দিন থেকে শুরু করে কালীপূজা পর্যন্ত মাছ মাংস ঢোকে না এই বাড়িতে। জন্মাষ্টমীর দিন সকালে ঢ্যাং বাড়ির ছেলেরা সবাই মিলে গঙ্গায় স্নান করে মাটি নিয়ে আসে। ঐ গঙ্গামাটি ও নতুন বাঁশ পুজো করেই পরিবারের নিজস্ব প্রতিমা শিল্পী মূর্তি গড়ারকাজ শুরু করে দেন। পারিবারিক রীতি মেনেই আজও ডাকের সাজের মূর্তি তৈরি করা হয়। এখনও ঐতিহ্য মেনেই হুগলির রাজাহাটি থেকে পুরোহিত এবং ঢাকিরা বংশানুক্রমে এখানে আসেন জন্মাষ্টমী তিথিতেই। টানা ১ মাস ৩০ দিন ধরে চলে নিজস্ব ঠাকুর দালানেই মূর্তি গড়ার কাজ।

ষষ্ঠীর দিন বেলবরণ করে ঘট স্থাপন করে শুরু হয় মায়ের বোধন। সপ্তমীর সকালে গঙ্গায় নবপত্রিকা স্নানের মধ্যে দিয়ে পূজার সূচনা হয়। নবপত্রিকাকে কনের সাথে লাল শাড়ি পরিয়ে গণেশের পাশে স্থাপন করা হয়। এরপর মায়ের চক্ষু দান করে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে পুজো শুরু হয়। সপ্তমীর বিকালে ঢ্যাং বাড়ির রীতি মেনেই বারো ব্রাহ্মণকে লুচি ফল মিষ্টি ও দক্ষিণা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। অষ্টমীর দিন আত্মীয় ও লোকসমাগমে ভরপুর হয়ে ওঠে ঢ্যাং বাড়ির দূর্গাদালান। অষ্টমী পুজো ও সন্ধিপুজোতে ধুনো পোড়ার রীতি মানা হয়। বাড়ির পুজোয় অন্নভোগ হয় না। সন্ধিপুজোতে একমন চালের নৈবেদ্য প্রদান করা হয় মাকে। চারদিন আনন্দের পর বেজে ওঠে মায়ের বিদায়ের শঙ্খধ্বনি। দশমীর দিন সকালে ঘট নাড়িয়ে বিসর্জন পর্ব শুরু হয়। এরপর সিঁদুর খেলা। রাতে মাকে বরণ করে সালকিয়ার শ্রীরাম ঢ্যাং ঘাট অর্থাৎ লোকমুখে যেটি ফুলতলা ঘাট নামে প্রচলিত সেইখানে মায়ের নিরঞ্জন হয়। বিসর্জনের পর সেই কাঠামো তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই কাঠামোতে পরের বছরের মূর্তি গড়া হয়। এই পরিবারে মহাসমারোহে লক্ষীপূজো ও কালীপূজা ও হয়ে থাকে। পরিবারের সদস্যদের অনেকেই কর্মসূত্রে দূরদেশে থাকেন, কিন্তু পুজোর সময় সকলেই ফিরে আসেন বাড়িতে । পরিবার ও এলাকার মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণে বাড়ির ঠাকুর দালান হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। আগের বছরের ন্যায় এই বছর ও সরকারি করোনাবিধি মেনেই পুজোর আয়োজন করা হবে।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!