“সব নারীই ভগবতীর বিগ্রহ”: সনাতন শাস্ত্র 

0 0
Read Time:7 Minute, 35 Second

নিউজ ডেস্কঃ সনাতন শাস্ত্র বলছে, সব নারীই ভগবতীর বিগ্রহ। ‘নারী’ শব্দটি সনাতন জীবন-সংস্কৃতিতে মাতৃত্বকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ঈশ্বরকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করে থাকেন এবং মাতৃরূপে পূজা করে থাকেন। শ্রীশ্রী দুর্গাপূজা আসলে ঈশ্বরের মাতৃভাব ও মাতৃরূপের উপাসনা। দুর্গাপূজায় দুর্গাপ্রতিমা ও নবপত্রিকা-প্রতিমায় ঈশ্বরীয় মাতৃভাব ও মাতৃরূপই প্রতিফলিত হয়।
পূজার অঙ্গ হিসেবে ‘দুর্গাপ্রতিমা’ কেবল ‘নারীর প্রতি মাতৃদৃষ্টি ও নারীর মাতৃভাব’ প্রকাশ করে তা নয়, নারীর শক্তি-সামর্থ্যের ব্যাপারও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। নারী একদিকে পবিত্রতা, দয়া, সহিষ্ণুতা, ভালোবাসা, ক্ষমা ইত্যাদি ভাবের প্রতিমূর্তি, অন্যদিকে নারী অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রতিমূর্তি। প্রতিমায় দৃষ্ট দেবী ও অসুরের যুদ্ধ যেন সেই ভাবেরই প্রতিভূ।

দুর্গাপূজা-প্রক্রিয়ার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের দিকে দৃষ্টি দিলে স্বামী বিবেকানন্দের নারী-পুরুষ সমদৃষ্টির ভাবটি আমরা প্রত্যক্ষ করে থাকি। ধূপ-দীপ-ফুল-ফল নৈবেদ্যাদি দিয়ে পূজা স্থূল ব্যাপার। এর পশ্চাতে রয়েছে পৌরাণিক আখ্যান ও সূক্ষ্ম দর্শন। ষষ্ঠীর কল্পারম্ভ ও বোধন থেকে শুরু করে দশমীর বিসর্জন পর্যন্ত ক্রিয়াবহুল এ পূজার প্রতিটি অঙ্গানুষ্ঠান তাৎপর্যমণ্ডিত।
পুরাণে আছে, দুষ্ট রাবণ বধ এবং শ্রীরামচন্দ্রকে অনুগৃহীত করার জন্য পুরাকালে ব্রহ্মাদি দেবতারা শরতে দেবীর বোধন করে পূজা করেছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র দেবী দুর্গাকে সংবোধিত করে হারানো স্বর্গরাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন। শ্রীরামচন্দ্র যেরূপ রাবণকে নিধন করেছিলেন, অধুনা বিবিধ উপচারে সম্পাদিত বোধনক্রিয়ায় পূজারির অভিপ্রায় ও চিন্তন—সেই রূপ রাবণরূপী শত্রুদের বধ করা। এরূপ আখ্যান অবলম্বনে পূজার পশ্চাতে কী দর্শন রয়েছে, তা ভেবে দেখা যেতে পারে।

ঈশ্বরই এক ও অভিন্ন চৈতন্য সত্তারূপে সর্বজীবে বিরাজিত। কিন্তু সাধনার প্রাথমিক স্তরে আমরা নিজেদের চৈতন্যস্বরূপ বোধ না করে নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, স্থূল-কৃশ—এরূপ বোধ করে থাকি। কেন এরূপ হয়ে থাকে? শাস্ত্রীয় দর্শন বলছে, অজ্ঞান উপহিত চৈতন্য থেকে সমগ্র জগৎ সৃষ্টি। শাস্ত্র ও যুক্তির নিরিখে বলা যেতে পারে, আমাদের চৈতন্যস্বরূপ সত্তার ওপর অজ্ঞান (স্বরূপ সম্পর্কে) এবং এর পরিণাম—দেহবোধের আবরণের জন্য নারী-পুরুষ ইত্যাদি ভেদ-দৃষ্টি হয়ে থাকে। দেহবোধ থেকেই স্বার্থপরতা, মোহ, ঈর্ষা, লোভ, হিংসা ইত্যাদি অশুভ ভাবের উদ্ভব—এটা বিচারশীল মন নিয়ে চিন্তা করলে বোঝা যায়। শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় আছে—মন যেন মাটিমাখানো ছুঁচ, ঈশ্বর চুম্বক পাথর, মাটি না গেলে চুম্বক পাথরের সঙ্গে যোগ হয় না। পূজা-উপাসনায় এবং ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা, অনুরাগ ও অনুতাপের অশ্রুজলে ছুঁচের মাটি ধুয়ে যায়, অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ, পাপবুদ্ধি, বিষয়বুদ্ধি দূরীভূত হয়। মাটি ধুয়ে গেলেই ছুঁচকে চুম্বক পাথর টেনে নেয়—অর্থাৎ ঈশ্বরদর্শন হয়। অন্তরে দেহবোধ ও কাম-ক্রোধাদি অশুভভাবরূপী রাবণ বিনাশই রামচন্দ্ররূপী পূজারির প্রয়াস। পৌরাণিক ভাষায় ও রূপক ছলে বলা হয়ে থাকে, রাবণ বিনাশে সীতা উদ্ধার কিংবা অসুর বিনাশে দেবরাজ ইন্দ্রের স্বর্গপ্রাপ্তি, এর মানে অন্তরে দেহবোধ লোপ ও চৈতন্য সত্তার উপলব্ধি। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখলে, এরূপ উপলব্ধিতেই নারী-পুরুষে যথার্থ সমদৃষ্টি সম্ভব।

দুর্গা দেবীর মানস পূজায় অনহংকার, অরাগ (অনাসক্তি), অমদ, অমোহ, অদম্ভ, অদ্বেষ…এরূপ ১৫টি শুভভাবের পুষ্পমেখলা মাকে নিবেদন রূপ মানসক্রিয়া পূজারির অন্তরে শুভভাবের উৎকর্ষের প্রয়াস। স্বচ্ছ জলাশয়েই সূর্যের প্রতিবিম্ব স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। শুভভাবের উৎকর্ষে চিত্ত শুদ্ধ হলে সাধকের পক্ষে হৃদয়ে উপাস্য জগজ্জননীর দর্শন, অর্থাৎ চৈতন্যস্বরূপ সত্তার উপলব্ধি সম্ভবপর হয়। মানস পূজায় বস্ত্রকে আকাশ তত্ত্বরূপে, চন্দনাদি গন্ধদ্রব্য-গন্ধতত্ত্বরূপে, এরূপে সমগ্র সৃষ্টিতত্ত্ব দেবীকে নিবেদন ক্রিয়া পূজারির দেহবোধ থেকে চৈতন্য সত্তায় উত্তরণের প্রয়াস। বলি ও হোম প্রক্রিয়ায়ও একই প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়।

স্বামী বিবেকানন্দের উল্লিখিত সমাজদর্শনের আলোকে বলা যেতে পারে, আমাদের প্রত্যাশিত প্রগতিশীল-সভ্য সমাজে নারীরা পরমুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে; দেশ ও সমাজের সব উন্নয়ন কর্মকাল অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখবে ও সাফল্যের অংশীদার হবে; কোনোরূপ বঞ্চনা বা নির্যাতনের শিকার হবে না এবং মর্যাদার সঙ্গে সমাজে অবস্থান করবে। তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে আমরা হয়তো নারীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের কিছুটা অগ্রগতি দেখাতে সমর্থ হব, সন্দেহ নেই। সমাজে নারী বঞ্চনা ও নিগ্রহের খবর যখন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তখন সে সমাজের প্রগতির সূচক যে খুব একটা বেশি, তা বলা যাবে না। এ সূচক বৃদ্ধিতে ও নারীসমাজের উন্নয়নকল্পে নারী-পুরুষ সমদৃষ্টি অপরিহার্য—এটা বলা বাহুল্য।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!