সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু

0 0
Read Time:11 Minute, 10 Second

নিউজ ডেস্ক::সুভাষচন্দ্র বসু (২৩ জানুয়ারি ১৮৯৭ – ?) ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক চিরস্মরণীয় কিংবদন্তি নেতা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তিনি হলেন এক উজ্জ্বল ও মহান চরিত্র যিনি এই সংগ্রামে নিজের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি নেতাজি নামে সমধিক পরিচিত। সুভাষচন্দ্র পরপর দুইবার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু গান্ধীর সঙ্গে আদর্শগত সংঘাত, কংগ্রেসের বৈদেশিক ও আভ্যন্তরীণ নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা এবং বিরুদ্ধ-মত প্রকাশ করার জন্য তাকে পদত্যাগ করতে হয়।

ঐতিহাসিকদের মতে, ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট, সুভাষচন্দ্র বসুকে বহনকারী জাপানি বিমান, জাপান শাসিত ফোরমোসায় (বর্তমান তাইওয়ান) বিধ্বস্ত হওয়ার পর, আগুনে দগ্ধ হয়ে বসুর মৃত্যু ঘটে। তবে, তার অনেক অনুগামীই, বিশেষত বাংলায়, সে সময় ঘটনাটি অস্বীকার করে এবং এমনকি এখনো তার মৃত্যু সম্পর্কিত পরিস্থিতি ও তথ্য অবিশ্বাস করে। তার মৃত্যুর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বহু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আবির্ভূত হয় এবং দীর্ঘকাল এগুলো তার মৃত্যু সম্পর্কে বিভিন্ন কল্পকাহিনী জীবিত রেখেছে।
তাইহোকুতে দুপুর আড়াইটার দিকে যখন সুভাষচন্দ্র বসু কে নিয়ে বোমারু বিমানটি উড্ডয়ন শুরু করে, তখনই এর যাত্রীরা বিমানের ইঞ্জিন থেকে একটি বিকট শব্দ শুনতে পান। রানওয়ের টারম্যাক থেকে কারিগরেরা বিমান থেকে কিছু পড়ে যেতে দেখেন। পড়ন্ত বস্তু ছিল পোর্টসাইড ইঞ্জিন অথবা এর একটি অংশ এবং প্রোপেলার। বিমানটি দ্রুত ডান দিকে ঝাঁকুনি দিয়ে এবং ভূমিতে বিধ্বস্ত হয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং আগুনে বিস্ফোরিত হয়। বিমানের ভেতরে, পাইলট, সহকারী পাইলট এবং জাপানি কোয়ান্তুং সেনাবাহিনীর ভাইস চিফ অফ স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল সুনামাসা শিদেই, যার সুভাষচন্দ্র বসুর পক্ষে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর সাথে মাঞ্চুরিয়ায় আলোচনা করার কথা ছিল, তাৎক্ষণিকভাবে নিহত হন। সুভাষচন্দ্র বসুর সহচর হাবিবুর রহমান কিছু সময়ের জন্য অচেতন হয়ে যান এবং বসু চেতনা না হারালেও তার দেহ জ্বালানিতে সিক্ত হয়ে ওঠে। রহমান চেতনা ফিরে পাওয়ার পর তারা পিছনের দরজা দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তারপর তারা আগুনের মধ্য দিয়েই দৌড়ে সামনে দিয়ে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বন্দরের লোকেরা বিমানের কাছে এসে দেখেন, দুজন লোক তাদের দিকে ছুটে আসছে, যাদের মধ্যে একজনের শরীরে আগুন জ্বলছে। এই ব্যক্তিটি ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। তার পোশাক জ্বালানি চুঁইয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে। রহমান এবং অন্য কয়েকজন মিলে আগুন নেভাতে সক্ষম হলেও লক্ষ করেন যে সুভাষচন্দ্রের মুখ ও মাথা গুরুতরভাবে দগ্ধ হয়েছে। জয়েস লেব্রার মতে, “একটা লরি যেটা অ্যাম্বুল্যান্স হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছিল, তা দ্রুত সুভাষচন্দ্র এবং অন্য যাত্রীদের তাইহোকুর দক্ষিণে নানমোন সৈনিক হাসপাতালে নিয়ে যায়।” বিমান বন্দরের কর্মচারীরা বেলা তিনটা নাগাদ হাসপাতালের সার্জেন-ইন-চার্জ ডা. তানেয়োশি ইয়োশিমির সাথে যোগাযোগ করেন। তারা হাসপাতালে পৌছানোর সময় ও তার কিছুক্ষণ পরও সুভাষচন্দ্র বসু সচেতন ও সংহত ছিলেন। ডা. ইয়োশিমি এসে তৎক্ষণাৎ দেখলেন বসুর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ, বিশেষত তার বুকে তৃতীয় মাত্রার দহন (থার্ড ডিগ্রি বার্ন) সংঘটিত হয়েছে, এতে তার সন্দেহ হয় যে বসু বাঁচবেন কী না। ডা. ইয়োশিমি তৎক্ষণাৎ বসুর চিকিৎসা শুরু করেন এবং তাকে সাহায্য করেন ডা. সুরুতা। পরবর্তীতে হাসপাতালের কর্মচারীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী ঐতিহাসিক লিওনার্ড গর্ডন এর বক্তব্য হল:

একটা জীবাণুনাশক, রিভামল, তার শরীরের অধিকাংশ স্থানে লাগানো হয় এবং এরপর একটি সাদা মলম প্রয়োগ করে তার শরীরের অধিকাংশে ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়। ডা. ইয়োশিমি, বসুর হৃদয়ের দুর্বলতার জন্য চারটি ভিটা ক্যাম্ফর এবং দুটো ডিজিটামাইন ইঞ্জেকশন দেন। এগুলো ৩০ মিনিট অন্তর অন্তর দেওয়া হয়েছিল। যেহেতু পুড়ে যাওয়ার কারণে তার শরীরের জলীয় পদার্থ কমে যায় তাই তাকে ধমনীর মাধ্যমে রিঙ্গার সলিউশন দেওয়া হয়। একজন তৃতীয় ডাক্তার, ডা. ইশি, তাকে রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। একজন সৈনিক ও আর্দালী কাজুও মিতসুই সেই ঘরে উপস্থিত ছিলেন এবং কয়েকজন নার্স চিকিৎসায় সহায়তা করছিলেন। তখনো সুভাষচন্দ্রের পরিপূর্ণ চেতনা ছিল যা এরূপ গুরুতর আহত ব্যক্তির পক্ষে চমকপ্রদ বলে ড. ইয়োশিমি মনে করেন।

এই চিকিৎসা সত্ত্বেও, শীঘ্রই সুভাষচন্দ্র বসু কোমায় চলে যান। কয়েক ঘণ্টা পর, ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট, শনিবার, রাত নয়টা থেকে দশটার মধ্যে (স্থানীয় সময়), ৪৮ বছর বয়স্ক সুভাষচন্দ্র বসু মৃত্যুবরণ করেন।

দুদিন পর, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২০ আগস্ট, তাইহোকু শ্মশানে সুভাষচন্দ্র বসুর মরদেহ দাহ করা হয়। যদিও তার মৃত দেহ কাউকে দেখানো হয়নি, এমনকি, মৃতদেহের কোনো ছবিও তোলা হয়নি।  ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৩ অগস্ট জাপানি সংবাদ সংস্থা কর্তৃক সুভাষচন্দ্র এবং শিদেয়ার মৃত্যুর খবর ঘোষণা করা হয়। ৭ সেপ্টেম্বর, একজন জাপানি অফিসার লেফটেন্যান্ট তাতসুও হায়াশিদা সুভাষচন্দ্রের চিতাভস্ম টোকিওতে বয়ে নিয়ে যান এবং পরদিন সকালে তা টোকিওর ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের সভাপতি রামা মূর্তির হাতে তুলে দেন। ১৪ সেপ্টেম্বর টোকিওতে সুভাষচন্দ্র বসুর জন্য একটি স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং তার কয়েকদিন পর তার চিতাভস্ম টোকিওর নিচিরেন বৌদ্ধধর্ম সম্প্রদায়ের রেনকোজি মন্দির এর সন্ন্যাসীর কাছে জমা দেওয়া হয়। এরপর থেকে তা সেখানেই স্থায়ীভাবে রাখা হয়েছে।

আজাদ হিন্দ ফৌজের কর্মীদের মধ্যে, সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু নিয়ে ব্যাপক অবিশ্বাস ও বিহ্বলতা বিরাজ করছিল। সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হন মালয় এবং সিঙ্গাপুরের তরুণ তামিল ভারতীয়রা (নারী ও পুরুষ উভয়েই), যারা আজাদ হিন্দ ফৌজে তালিকাভুক্ত বেসামরিক নাগরিকদের সিংহভাগ গঠন করেছিল। এসময় আজাদ হিন্দ ফৌজ এর পেশাদার সৈন্যরা, যাদের অধিকাংশই পাঞ্জাবি, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্মুখীন হন। অনেকে আবার ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে ভয়াবহ প্রতিশোধ প্রত্যাশা করতে শুরু করেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আনুষ্ঠানিক অবস্থান, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী কর্তৃক অমৃতা কাউর এর উদ্দ্যেশ্যে লেখা একটি চিঠির মাধ্যমেই সংক্ষেপে প্রকাশ করা যায়: “সুভাষ বসু ভালোভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি বিপথগামী হওয়া সত্ত্বেও নিঃসন্দেহে একজন দেশপ্রেমিক ছিলেন।”গান্ধীর সঙ্গে বিবাদ এবং যাকে তারা জাপানি ফ্যাসিবাদ বলে বিবেচনা করে তার সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য কংগ্রেসের অনেক সদস্যই সুভাষচন্দ্রকে ক্ষমা করতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রায় ২৫ লক্ষ ভারতীয় সৈন্য আজাদ হিন্দ ফৌজ সম্পর্কে দ্বিধান্বিত ছিল। অনেকে আজাদ হিন্দ ফৌজ এর সদস্যদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে দেখতো এবং চাইতো যে তাদের শাস্তি হোক, আবার অন্যরা তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতো। ব্রিটিশ রাজ, আজাদ হিন্দ ফৌজ কে গুরুতর হুমকি মনে না করলেও, এর ৩০০ অফিসারের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য বিচার শুরু করে, কিন্তু পরিশেষে তা থেকেও পিছিয়ে আসে।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!