মেদিনীপুরের ‘বিস্ময় কিশোর’ সৌহার্দ্য ‘প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় বাল পুরস্কার’ এ সম্মানিত

3 0
Read Time:11 Minute, 21 Second

নিউজ ডেস্ক: মাত্র ১৩ বছর বয়সে ইংরেজিতে রামায়ণের কাব্য রূপ দান করে পুরাণ ও সাহিত্যচর্চায় হাতেখড়ি। একরত্তি ছেলে ইন্টারনেট ঘেঁটে নিজেই জুটিয়ে নিয়েছিল প্রকাশকও। অ্যামাজনের মতো অনলাইন সপিং প্ল্যাটফর্মগুলিতে সেই বই রমরমিয়ে বিক্রি হচ্ছে এখনও। এরপর, ইংরেজিতেই রামায়ণের নাট্যরূপ রচনা করে ‘ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডস’ (India Book of Records) ছিনিয়ে নেওয়া। সর্বকনিষ্ঠ সদস্য রূপে, মাত্র ১৫ বছর বয়সে (২০১৯ সালে) ‘রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি’ (Youngest Fellow of Royal Asiatic Society, London) থেকে ফেলোশিপ (FRAS) অর্জনের মতো অনন্য কীর্তি সাধনও করেছে সে। The Statesman, Times of India, Sunday Guardian এবং Lokmat Times Zest এর মতো প্রথম সারির সংবাদপত্র গুলির একজন উল্লেখযোগ্য লেখক (Columnist) বা প্রতিবেদক রূপে এই মুহূর্তে সারা দেশে সমাদৃত এই স্বতন্ত্র প্রতিভাসম্পন্ন কিশোর। আর, এবার পশ্চিমবঙ্গ থেকে একমাত্র যোগ্য প্রার্থী রূপে “প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় বাল পুরস্কার- ২০২১” এ ভূষিত হল বাংলার এই বিস্ময় কিশোর। হ্যাঁ, ‘রত্নগর্ভা’ মেদিনীমাতারই জ্যোতির্ময় সন্তান সে। নাম সৌহার্দ্য দে (Souhardya De)। বর্তমানে, মেদিনীপুর শহরের বিদ্যাসাগর শিশু নিকেতন (Vidyasagar Sishu Niketan) এর একাদশ শ্রেণীতে পাঠরত। বয়স মাত্র ১৭। ছোট থেকেই পুরাণ (Mythology) আর প্রাচীন ইতিহাসের (Ancient History) প্রতি অমোঘ আকর্ষণ সৌহার্দ্য’র। সেই আকর্ষণ আর ভালোবাসা থেকেই সপ্তম শ্রেণীতে পড়াকালীন (মাত্র ১৩ বছর বয়সে) সে বাল্মীকি ‘রামায়ণ’ অনুসরণে ইংরেজি কাব্যের আকারে রচনা করেছিল- “Scion of Suryavansh” (সিঁও অফ সূর্যবংশ, বাংলায়- সূর্যবংশের বংশধর বা কুলতিলক)। ইন্টারনেট ঘেঁটে নিজেই জুটিয়ে নিয়েছিল প্রকাশক। ‘ক্রিয়েট স্পেশ’ থেকে বই আকারে বেরোনোর পর বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন, সৌহার্দ্য’র বাবা, মেদিনীপুর কলেজ (স্বশাসিত) এর ইতিহাসের অধ্যাপক ড. শক্তি প্রসাদ দে এবং মা, পিড়াকাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষিকা জয়তী দে। এরপর আর থেমে থাকেনি সৌহার্দ্য’র জয়যাত্রা। ইংরেজিতে রামায়ণের নাট্যরূপ সম্বলিত তার পরবর্তী বই “Choronicles of Suryavansh” (সূর্যবংশের ইতিহাস)। সূর্যবংশের ইতিকথা এভাবে নাট্যরূপে কখনও প্রকাশিত হয়নি, তাই ২০১৯ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই সৌহার্দ্য অর্জন করল, ‘ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডস’ (India Book of Records) এর অনন্য সম্মান। প্রসঙ্গত, সৌহার্দ্য রচিত দুটি বইই সূর্যবংশের ‘কুলতিলক’ শ্রীরামচন্দ্রের দিব্যবিভায় আলোকিত। ২০১৯ সালেই গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রতিষ্ঠান “Royal Asiatic Society” (রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি) থেকে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য রূপে ‘ফেলোশিপ’ (Youngest Fellow of Royal Asiatic Society) অর্জন করে দেশ, রাজ্য ও জেলা’কে এক অনন্য সম্মানে সম্মানিত করতে সক্ষম হয়েছিল মেদিনীপুরের সৌহার্দ্য। শুধু তাই নয়, আইসিএসসি (ICSC) বোর্ড থেকে ৯৬ শতাংশ নম্বর নিয়ে মাধ্যমিক পাস করা এই মেধাবী ও কৃতি ছাত্রটি বিজ্ঞান শাখাতে যথেষ্ট সাবলীল ও দক্ষ হয়েও, এক অনাবিল আকর্ষণ বা আত্মিক টানেই কলা শাখা (Humanities) নিয়ে একাদশে ভর্তি হয়েছে নিজের স্কুল বিদ্যাসাগর শিশু নিকেতনেই। স্বল্প বয়সেই গুজরাট সহ বিভিন্ন রাজ্যে বিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রকল্প (Project Competition) প্রতিযোগিতায় বিদ্যালয়ের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে, শীর্ষস্থানগুলি দখল করার পরও, পুরাণ আর ইতিহাস চর্চায় নিমগ্ন হয়ে আছে সে। বই লেখার সাথে সাথে দেশের প্রথম সারির সংবাদপত্র ও বিদেশের প্রথম সারির জার্নাল গুলিতে নিয়মিতভাবে লিখে চলেছে সৌহার্দ্য। ঐশ্বরিক প্রতিভা সম্পন্ন এই ‘বিস্ময় কিশোর’ কে কেন্দ্রের নারী ও শিশু কল্যাণ (Women and Child Development Ministry) মন্ত্রক “প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় বাল পুরস্কার- ২০২১” এর জন্য মনোনীত করেছে গত ২২ শে জানুয়ারি। সারা দেশের ৩২ জন ‘ব্যতিক্রমী ও অনন্য ক্ষমতাসম্পন্ন’ শিশু ও কিশোরদের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে একমাত্র নাম সৌহার্দ্য দে। গতকাল (২৫ শে জানুয়ারি) স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই ৩২ জন ‘বিস্ময় সন্তান’ এর সঙ্গে আলাপচারিতায় মগ্ন হয়েছিলেন (ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে)।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শিল্পকলা, সংস্কৃতিচর্চা, খেলাধুলা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহসিকতা, সৃষ্টিশীলতা প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সমস্ত শিশু, বালক-বালিকা ও কিশোর-কিশোরীরা ব্যতিক্রমী প্রতিভা বা অবদানের স্বাক্ষর রাখে, তাদেরই কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তরের পক্ষ থেকে এই ‘প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় বাল পুরস্কার’ এ সম্মানিত করা হয়। ২০২১ সালে সারা দেশের ২১ টি রাজ্য (সবকটি রাজ্য থেকে নির্বাচিত/মনোনীত হয়নি) থেকে ৩২ জন শিশু ও কিশোর-কিশোরীকে বেছে নেওয়া হয়েছে এই পুরস্কারের জন্য। উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মণিপুর, গুজরাট, বিহার প্রভৃতি রাজ্যের সাথে সাথে পশ্চিমবঙ্গ থেকেও এক এবং একমাত্র কৃতি সন্তান রূপে মেদিনীপুরের সৌহার্দ্য দে (১৭) এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। সৌহার্দ্য’র বাড়ি মেদিনীপুর শহরের রবীন্দ্রনগরে। বাবা ও মা দু’জনই যথাক্রমে ইতিহাস বিষয়ের অধ্যাপক ও শিক্ষিকা। তবে, সৌহার্দ্য’র এই পুরাণ ও ইতিহাস প্রীতি একেবারেই সহজাত বলে জানিয়েছেন, তার গর্বিত মা জয়তী দে। তিনি বললেন, “ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলেই মনে করছি। ও বিজ্ঞানের বিষয়গুলিতেও যথেষ্ট সাবলীল। তবে, প্রাচীন ভারতীয় পুরাণ, ইতিহাস প্রভৃতির প্রতি ওর ভালোলাগা, ভালোবাসা এবং সৃজনশীলতা এগুলি একেবারেই সহজাত। আমরা প্রথম প্রথম উপেক্ষাই করেছিলাম, সেভাবে গুরুত্ব দিইনি। তারপর ধারাবাহিকভাবে ও নিজের সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়ে আমাদেও মুগ্ধ-বিবশ করেছে। বিজ্ঞানের বিষয়গুলি নিয়ে রাজ্য ও জাতীয় স্তরের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সফল হওয়ার পরও, ও পুরাণ চর্চা ও লেখালিখি চালিয়ে গেছে আন্তরিক ভাবে। সবকিছুর জন্য ঈশ্বরকেই ধন্যবাদ জানাব।” একই কথা জানিয়েছেন, মেদিনীপুর কলেজের অধ্যাপক তথা সৌহার্দ্য’র বাবা শক্তি প্রসাদ বাবুও। উল্লেখ্য যে, পড়াশোনা আর লেখালেখি বা গবেষণা ছাড়াও সৌহার্দ্য কম্পিউটার আর আধুনিক প্রজন্মের বিভিন্ন বিনোদন ও শিক্ষিমূলক অ্যাপস, ওয়েবসাইট, অনলাইন প্রোগ্রাম প্রভৃতিতেও দক্ষ ও পারদর্শী। সোহার্দ্য এই মুহূর্তের একজন জনপ্রিয় পডকাস্টার (Podcaster)। কসমোগ্রাফিয়া (Cosmographia) নামক প্ল্যাটফর্ম থেকে অনলাইনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পডকাস্ট (Podcast) বা প্রচার করে সে। অপরদিকে, এই বয়সেই সে একজন নামকরা জার্নালিস্টও। Sunday Guardian এবং Lokmat Times Zest এর নিয়মিত লেখক বা প্রতিবেদক। এছাড়াও, The Statesman, Times of India তেও প্রায়শই সৌহার্দ্য’র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি, পুরাণ ও ইতিহাস নির্ভর সেই সমস্ত প্রতিবেদন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বহুল প্রশংসিত। সৌহার্দ্যের পরবর্তী বই, মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে খুব শীঘ্রই প্রকাশিত হবে রুপা পাবলিকেশন ইন্ডিয়া থেকে। এভাবেই, সৌহার্দ্যের সৃষ্টি-আলোয় আলোকিত হয়ে চলেছে শুধু অতীত ইতিহাস নয়, ঐতিহ্যমণ্ডিত শহর মেদিনীপুর তথা সারা বাংলা ও ভারতবর্ষ। আর সৌহার্দ্য, যার হোয়াটসঅ্যাপ স্টেটাসে লেখা ‘Proud Indian’ (গর্বিত ভারতীয়), সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়ায় শুধু এটুকুই জানাল, “নিজেদের কৃষ্টি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পরম্পরা, সমাজ, ইতিহাস ও বিজ্ঞান এসবই তো পরস্পরের পরিপূরক। ইতিহাস ও আধুনিকতার মেলবন্ধনে ভারতীয় সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করার ঐকান্তিক প্রয়াস চালিয়ে যেতে চাই, আপনাদের সকলের আশীর্বাদে।”

Happy
Happy
33 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
67 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!