জেনে নিন বহু প্রাচীন গাজন উৎসবের অজানা কাহিনী!
নিউজ ডেস্ক::চৈত্র শেষের পথে। নীলপুজোর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গিয়েছে শিবের গাজনও। রাজ্যের একাধিক জেলায় চলছে গাজন উৎসব। চৈত্র মাসে এই শিবের গাজনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে গ্রামবাংলার লোক সংস্কৃতি। একেক জায়গায় চড়কের মেলা গাজন উৎসবকে কেন্দ্র করে বিশাল মেলার আয়োজন করা হয়।
একেক জায়গার গাজন উৎসবের একেক রকম কাহিনী-রীতি নীতি প্রচলিত রয়েছে। সেরকমই কান্দির এই ৭০০ বছরের প্রাচীন গাজন উৎসবেরও রয়েছে একাধিক বিশেষত্ব। তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল নরমুণ্ড নিয়ে নাচ।
৭০০ বছর ধরে চলে আসছে এই প্রথা। প্রতিবছর চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে গাজন উৎসব পালন করে কান্দি রুদ্রদেব মন্দিরে ভক্তরা। বৃহস্পতিবার ভোর থেকেই চিরা চরিত প্রথা অনুযায়ী নরমুণ্ড নিয়ে নাচ শুরু করে দিয়েছেন শিব ভক্তরা।
কান্দি শহরের প্রাচীন উৎসব বলে পরিচিত এই গাজন। প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি ভক্তের সমাগম হয় এই অনুষ্ঠানে। এদিন মন্দিরের দেবতা রুদ্রদেব কে একদিন এর জন্য পালকি তে করে কান্দি শহর পরিক্রমা করা হয়। তারপর সেই রুদ্রদেবকে নিয়ে গিয়ে রাখা হয় হোমতলায়। এই রুদ্রদেব আসলে শিব।
কথিত আছে, কান্দি রূপপুরের রুদ্রদেবের গাজনে এই দিকটি বিশেষভাবে ধরা পড়ে। রুদ্রদেব অক্ষোভ্য বুদ্ধ। বজ্রযানে ও সহজযানে অক্ষোভ্যকুলের গুরুত্ব অপরিসীম। অক্ষোভ্যকুলের দেবদেবীগণ ঘন নীলবর্ণ, প্রজ্ঞার মূর্ত প্রতীক। একজটা, পর্ণশবরী, হেবজ্র, আর্যজাঙ্গুলি, মহাচীনতারা, যমান্তক, মহাকাল, চর্চিকা, নৈরাত্মার উপাসনার পথে; উড্ডিয়ানের সাধকদের বিশিষ্ট সাধনক্রমের মাধ্যমে এই কুলেই ভয়ঙ্করী ভয়হরা আদিমাতৃকার আদি সাধনার ধারাটি পুনরায় আত্মপ্রকাশ করেছিল পাল-সেনযুগে। কালীর বর্তমান রূপের উত্থানও এই কুলের সাথে সংযুক্ত।
গাজনের জগরন রাত্রি থেকে কেউ লাউসেনপাতা, কেউ রুদ্রদেবপাতা, কেউ কালিকাপাতা। এখানে পাতা অর্থে পালনকর্তা। মনে রাখতে হবে পা শব্দটি সহজযানে চুরাশি মহাসিদ্ধের নামের সাথে সংযুক্ত ছিল। লুইপা, কুক্কুরীপা, সরহপা, কাহ্নুপা থেকে শুরু করে নারোপা, বিরূপা, ঢেন্ঢণপা পর্যন্ত এই রীতিই দেখা যায়। পাতা শব্দটি কি সেই নামকরণের রীতির সাথেই যুক্ত? কল্পনা করুন পালযুগের উড্ডিয়ান। দেবী বজ্রযোগিনীর মহাপীঠে অগণিত সহজযানীর সমাবেশ ঘটেছে। তাঁরা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন। কেউ দারিকপা শিষ্য। কেউ শবরীপার সহচর। কেউ অজোকাপার সাথে এসেছেন। কেউ ভুসুকুপার সাথে।
রুদ্রদেবের গাজনে ভক্তদের এই নামকরণও বোধহয় সেভাবেই হয়েছে। তন্ত্রের এক একটি ধারার ঐতিহ্য সঙ্গে নিয়ে। এখানে কোনো দল আসেন ঘোর লালরঙে নিজেদের আপাদমস্তক রাঙিয়ে। কেউ আসেন কালোরঙ মেখে। লাল কালো এই দুই রঙ উপমহাদেশে মাতৃসাধনার সাথে বহুকাল ধরেই নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। আবার সাদা, লাল, কালো, হলুদ ও সবুজ এই পাঁচ রঙ বজ্রযান ও সহজযানে পঞ্চ কুলের বর্ণও বটে।
ভক্তরা এই রঙের পাশাপাশি নিজেদের সাজান সাদা ফুলের মালায়। আর পরিধান করেন নরকরোটির মালা। গাজন উৎসব উপলক্ষে মুল আকর্ষণ থাকে মরা মৃত মরার মাথা কঙ্কালের নাচ। মন্দির প্রাঙ্গনে কঙ্কালের দেহাবশেষ নিয়ে শুরু হয় শ্মশান বোলান। আর তা দেখতে ভিড় জমান বহু সাধারণ মানুষ বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই।