স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়া বাংলার কয়েকজন বিশিষ্ট নারী
Read Time:9 Minute, 9 Second
নিউজ ডেস্কঃ প্রথমে ৩০০ বছর মুসলিম শাসন ও পরে প্রায় ২০০ ব্রিটিশ শাসনের জাঁতাকলে পরে ভারতীয়রা ভুলেই গিয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বাদ। তাঁরা ভেবেই নিয়েছিলেন, পরাধীনতার তাদের ভাগ্য। কিন্তু প্রথম ধাক্কাটা দেওয়া হয় ‘সিপাহী বিদ্রোহ’এর মাধ্যমে। তাই সিপাহী বিদ্রোহকে কার্ল মার্ক্স ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলেছিলেন। সেই সময় সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম সারিতে ছিলেন ঝাঁসির রানী লক্ষ্মী বই। এছাড়া ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে আমরা মনে রেখেছি মাত্র কয়েকজ নারীকে – যেমন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার,কল্পনা দত্ত, সরলাদেবী, সরোজিনী নাইডু প্রমুখ প্রবাদ প্রতিম মহিলাকে। কিন্তু এর বাইরেও অজস্র মহিলা আত্মনিয়োগ করেছিলেন ভারতের স্বাধীনতার জন্য। তাঁদের মধ্যেই তিন জনের কথা এখানে আমরা উল্লেখ করছি।
- ননীবালা দেবী – ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যে মহিলার নাম প্রথমেই উচ্চারিত হবে,তিনি ননীবালা দেবী। বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দি। জন্ম ১৮৮৮ সালে, হাওড়া জেলার বালিতে। বাবা সূর্যকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, মা গিরিবালা দেবী। ১৮৯৯ সালে মাত্র এগারো বছর বয়সে বিয়ে। পাঁচ বছরের মাথায় ১৯০৪ সালে স্বামী মারা যান। তাঁর বয়স তখন মাত্র ষোলো। এর পর তিনি তাঁর বাবার কাছেই ফিরে আসেন। চারদিকে তখন দেশপ্রেমীদের উপর ব্রিটিশের পৈশাচিক অত্যাচার। এই সময়ই বিপ্লবী অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে বিপ্লবের দীক্ষা পেলেন বাল্যবিধবা ননীবালা দেবী।
১৯১৫ সালে আলিপুর জেলে বন্দী বিপ্লবী রামচন্দ্র মজুমদারের কাছ থেকে গোপন তথ্য আনার জন্যে ঐ বন্দীর স্ত্রী পরিচয়ে দেখা করেন পুলিশকে কিছুমাত্র জানতে না দিয়ে। ততকালীন যুগে একজন বিধবা হিন্দু মহিলার এই সাহসী পদক্ষেপ প্রায় অকল্পনীয় ছিল। এরপরে বিভিন্ন সময় পলাতক বিপ্লবীদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে চন্দননগর শহরে গৃহকর্ত্রীর ছদ্মবেশ নিয়েছেন। পুলিশ তাকে সন্দেহ করলে গ্রেপ্তারি এড়াতে পেশোয়ার চলে যান। ব্রিটিশ পুলিশ তাকে কলেরা রোগাক্রান্ত অবস্থাতেই গ্রেপ্তার করে ও বেনারস জেলে পাঠায়। তাঁর উপর নেমে আসে অকথ্য অত্যাচার। প্রেসিডেন্সি জেলে তিনি অনশন ধর্মঘট শুরু করলে কারা কর্তৃপক্ষ নড়ে চড়ে বসে, কি শর্তে তিনি অনশন ত্যাগ করবেন জানতে চাইলে ননীবালা লিখিত জানান বাগবাজারে শ্রীরামকৃষ্ণ পত্নীর কাছে রাখা হলে তিনি অনশন ভংগ করবেন। সাহেব অফিসার সেই দরখাস্ত ছিঁড়ে ফেললে তিনি সাহেবকে চড় মেরে অপমানের প্রতিশোধ নেন বলে শোনা যায়। তিনি অনশন করেছিলেন টানা একুশ দিন। তাকে ১৯১৮ সালের ৩ নং রেগুলেশনে স্টেট প্রিজনার হিসেবে আটক রাখা হয়। বাংলার তিনিই একমাত্র মহিলা স্টেট প্রিজনার। ১৯১৯ সালে মুক্তিলাভ করেন বিপ্লবী ননীবালা দেবী। তার শেষ জীবন অসহায় ও নির্বান্ধব অবস্থায় কেটেছে।
- দুকড়ি বালা দেবী – ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যে নারীরা সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন,তাঁদের মধ্যে অন্যতম দুকড়ি বলা দেবী। পুরুষদের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রধান শ্লোগান ছিল – ‘তোমরা যদি দেশের জন্য প্রাণ দিতে পারো, তোমাদের মেয়েরাও পারে।’ বীরভূমের এই দুকড়িবালা দেবীই হলেন পরাধীন ভারতের প্রথম অস্ত্র আইনে দণ্ডিতা মহিলা। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশকে স্বাধীনতা দিতে বীরভূমের এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর অবদান ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লেখা অধ্যায়। দুকড়িবালা দেবী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে ‘মাসিমা’ বলে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন বীরভূমের নলহাটির প্রত্যন্ত এক গ্রাম ঝাউপাড়ার বাসিন্দা। যে গ্রামটি ব্রাহ্মণী নদী ঘেঁষা এবং ব্রাহ্মণী নদী ও তিরপিতা নদী দিয়ে ঘেরা।
এই ঝাউপাড়াতেই এসেছিলেন বিপ্লবী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী। তাঁর কাছেই দুকড়িবালা দেবী বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিতা হন।
১৯১৭ সালের ৭ জানুয়ারি পুলিশ বাহিনী নিয়ে নলহাটি থানা থেকে দারোগাবাবু যান ঝাউপাড়ায়। রাতেই দলবল নিয়ে ঘিরে ফেলা হয় মাসিমার বাড়ি। আর এর পরেই শুরু হয় সেই হাড়হিম করা সেদিনের ভোররাতের অজানা কাহিনি। পুলিশে ঘুরে ধরে তাঁর বাড়ি। ব্রিটিশ পুলিশের সাথে দীর্ঘ বাকবিতণ্ডার পরে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। জেলে শুরু হয় তাঁর উপর নির্মম অত্যাচার। বীরভূম তথা ভারতের এই মহীয়সী মহিলা ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুলাই বীরভূমের নলহাটি থানার ঝাউপাড়া গ্রামের নীলমণি চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পরে বিয়ে হয় গ্রামেরই ফণীভূষণ চক্রবর্তীর সাথে। তাঁর তিন সন্তান। প্রথম সন্তান সুধীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, দ্বিতীয় সন্তান সৌরেন্দ্র কুমার চক্রবর্তী এবং তৃতীয় সন্তান সমরেন্দ্র কুমার চক্রবর্তী। এই মহীয়সী মহিলা পরে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৮ এপ্রিল বার্ধক্যজনিত কারণে অমরত্ব লাভ করেন
- কল্যাণী দাস – ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা বিশেষ নাম। কল্যাণী দাস ১৯০৭ সালে কৃষ্ণনগরে এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু পিতৃভূমি ছিল চট্টগ্রাম। তার পিতার নাম বেণী মাধব দাস ও মাতার নাম সরলা দাস। তার বোন বীণা দাসও সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন । ১৯২৮ সালে বি.এ. পাস করবার পর তিনি ইউনিভার্সিটিতে এম.এ. পড়তে যান। ছাত্রাবস্থায় কলিকাতার স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের নিয়ে এই ‘ছাএীসংঘ’ গঠিত হয়।
কল্যাণী দাসের পরিবার ছিল রাজনৈতিক পরিবার। অসহযোগ ও জাতীয় আন্দোলনের যোগ দেওয়ার কারণে তার মেজদাদা কারাবরণ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি রাজনৈতিক মনস্ক হয়ে ওঠেন। সে সময় যুগান্তর দল এর কতিপয় সদস্যের সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। ১৯৩০ সালে ডালহৌসির অত্যাচারের বিরুধে প্রতিবাদের জন্য আইন অমান্য করে আন্দোলন ছাত্রীদের যোগদানের জন্য নেতৃত্ব দেন। ১৯৩২ সালে ‘আইন অমান্য আন্দোলন’এ অংশ নেন এবং গ্রেপ্তার হন। ভারতের স্বাধীনতা পরে দেশের বিকাশের জন্য তিনি একাধিক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। কল্যাণী দাসের ১৯৮৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু হয়।