রাখি-বন্ধন ও রবীন্দ্রনাথ
নিউজ ডেস্ক::আধুনিক বাংলায় রাখি বন্ধন উৎসবের সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ ও রবীন্দ্রনাথ ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। রাখি বন্ধনের নানা ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক প্রেক্ষাপট পাওয়া গেলেও আধুনিক বাংলায় এই উৎসবকে সবার সামনে নিয়ে আসেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ – ১৯০৫ সালে। ব্রিটিশ সরকারের বিভাজন নীতিকে আটকাতে কিছু একটা করতেই হবে। রাজনৈতিক থেকে সামাজিক পরিসরে বাঙালির তখন এই একটাই চিন্তা। এমন সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বললেন, রাখিবন্ধন করতে হবে। বাঙালির মধ্যে ঐক্যের সূত্র হবে সেটাই। তবে একটা অনুষ্ঠান করা তো আর মুখের কথা নয়। তার জন্য প্রস্তুতি চাই, তিথি স্থির হওয়া চাই। তবে তিথি স্থির হল নক্ষত্রের অবস্থান মিলিয়ে নয়, বরং ব্রিটিশ সরকার যেদিন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবে শিলমোহর দেওয়ার কথা জানাল সেদিনই স্থির হল ‘রাখী বন্ধন উৎসব’। ব্রিটিশ সরকার উদ্দেশ্যমূলক ভাবে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করলেন যেন এই দুই সম্প্রদায় পরস্পরের শত্রু!
কিন্তু কোন দিন রাখিবন্ধন উৎসব করা হবে? পঞ্জিকার তিথি অনুযায়ী নয়, রবীন্দ্রনাথ বললেন যে দিন ব্রিটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করবে,সেই দিনই সমস্ত হিন্দু মুসলমান যৌথভাবে পালন করবে রাখি বন্ধন উৎসব। , সেই দিনটা ছিল ১৬ অক্টোবর ১৯০৫। কথক ঠাকুর ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীর চেষ্টায় সেবারের পঞ্জিকাতেও স্থান পেয়েছিল দিনটি। তবে তিনি বলেছিলেন, পঞ্জিকায় এই দিনটা থেকে যাবে। এখন অন্তত আর নেই। এমনকি কত বছর পর্যন্ত ১৬ অক্টোবর দিনটি বাঙালির রাখি বন্ধন উৎসব বলে পরিচিত ছিল, তারও কোনো সঠিক ইতিহাস জানা যায় না।
তবে রাখির সঙ্গে সেই মৈত্রীর সম্পর্ক যেন আজও থেকে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের রাখি বন্ধন উৎসব নিঃসন্দেহে সেই সময়ের একটি রাজনৈতিক কার্যক্রম। তবে সেইসঙ্গে এক নতুন কাজও বটে। গাড়ি হাঁকিয়ে সাহেবি কেতায় মিটিং করা আর নয়। বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে গেলে ধরে রাখতে হবে বাংলার সংস্কৃতিকে। ছুঁইয়ে দেখতে হবে বাংলার রূপ-রস-গন্ধকে। তাই ঠিক হল সকাল সকাল জগন্নাথ ঘাটে স্নান সেরে সকলে সকলের হাতে রাখি পরিয়ে দেবে। আর পুরো রাস্তাটাই যাওয়া হবে পায়ে হেঁটে। রবীন্দ্রনাথ একাই নন, ঠাকুরবাড়ির যেসব তরুণের তখন গাড়ি ছাড়া মাটিতে পা পড়ত না তাঁরাও চললেন পায়ে হেঁটে। এরপর শুরু হল শোভাযাত্রা।
রবীন্দ্রনাথের সেই অমর বাণী ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ যেন প্রাণ পেল দীনেন্দ্রনাথের গলায়। এর মধ্যেই হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ পথের ধারে দেখা গেল একদল ঘোড়াকে দলাই-মলাই করছেন কয়েকজন সহিস। ধর্মে তাঁরা প্রত্যেকেই মুসলমান। অথচ সেসব কিছুই না ভেবে রবি ঠাকুর সোজা চলে গেলেন তাঁদের কাছে। সঙ্গে যোগ দিলেন বাকিরাও। সহিসদের হাতে রাখি পরিয়ে দেওয়া হল প্রথমেই। এরপর প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই তাঁদের কোলে তুলে নিলেন সবাই। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের ভীত পুনরায় স্থাপন করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।